ইতিহাস - প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
Wellcome to National Portal

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার


Text size A A A
Color C C C C

সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ৬ নভেম্বর ২০১৪

ইতিহাস

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার ইতিহাস

ব্রিটিশ শাসনামল
প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে আদিবাসী  শিক্ষা ব্যবস্থা প্রধানত আধ্যাতিক ও দার্শনিক মতবাদে প্রভাবিত ছিল। এই শিক্ষা ব্যবস্থাটি সাধারণ জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। বর্তমানে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে পরিচিত শিক্ষা ব্যবস্থাটির গোড়াপত্তন ও বাস্তবায়ন করেন একজন ব্রিটিশ।

উইলিয়াম অ্যাডামস, তাঁর শিক্ষা প্রতিবেদনে, নিম্নলিখিত পয়েন্টগুলোর প্রতি বিশেষ জোড় দিয়েছিলেন:

  • জেলা ভিত্তিক শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ।
  • নিজ মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তকের প্রচলন।
  • শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতি জেলায় ইন্সপেক্টর নিয়োগ।
  • শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য সাধারণ বিদ্যালয় স্থাপন।
  • জমি দাতাকে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগদান করে উৎসাহিত করা।
  • প্রতিদন্ধিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে বৃত্তি পরীক্ষার প্রচলন।

১৮৫৪ সনের উডের ডেসপ্যাচ তত্ত্ব ছিল ব্রিটিশ শাসক কতৃক বাংলার শিক্ষা ব্যবহার আধুনিকীকরণ করার প্রক্রিয়ার একটি উৎকৃষ্টতম উদাহরণ।  ১৮৫৫-৫৬ সময় কালের মধ্যে এই তত্ত্বের সুপারিশ অনুযায়ী পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগ নামে নতুন একটি বিভাগ চালু করা হয়। উক্ত বিভাগে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার একটি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। উডের ডেসপ্যাচ তত্ত্বে বে-সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থপনেও উৎসাহিত করা হয়।

 

লর্ড কার্জন প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহন করেন। ১৯১০ সনে গোপাল কৃষ্ণ গোখলে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার জন্য আইন পরিষদে একটি বিল উৎথাপন করেন। তবে ১৯৯২ সনে বিলটি খারিজ হয়ে যায়, তার পরিবর্তে পৌর এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা  বাধ্যতামূলক করার একটি বিল পাশ হয়। ১৯২১ সনের ইন্ডিয়ান পুস্তক আইনে সীমিত আকারে স্বায়ত্ব শাসনের বিধান রাখা হয়, ১৯৩০ সনে বেঙ্গল (পল্লী এলাকা) প্রাথমিক শিক্ষা আইন প্রনয়ণ করা হয়েছিল। তারপরের দশকে উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এই আইনের অধীনে শিক্ষা সম্প্রসারণ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রনের জন্য, সর্বোপরি বিনামূল্যে এবং সার্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষার লক্ষ্য পূরণে জেলা স্কুল বোর্ড গঠন করা হয়। যদিও প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ন্ত্রন পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল পরিচালক, পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগের উপর, স্কুলগুলো পরিদর্শন করা হতো জেলা, মহকুমা এবং সার্কেল অফিস (এক বা একাধিক থানা বা উপজেলা নিয়ে গঠিত)  কতৃক, তবে সার্বিক প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল শুধুমাত্র জেলা স্কুল বোর্ডের উপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, শিক্ষা উন্নয়নের জন্য সার্জেন্ট কমিশনের রিপোর্ট (১৯৪৪) প্রকাশিত হয়। এটাই প্রথম রিপোর্ট যাতে প্রাক-প্রথমিক শিক্ষাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ১৯৪৭ সনে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে, সার্জেন্ট কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন বন্ধ হয়ে যায়।

 

পাকিস্তান আমল (১৯৪৭-১৯৭১)
ভারত বিভক্তির পর, সার্বজনীন বাধ্যতামূলক এবং বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য একটি রেজুল্যেশন জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে (১৯৪৭) উপস্থাপন করা হয়। ১৯৫৭ সনে সরকার জেলা স্কুল বোর্ড ভেঙ্গে দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার প্রশাসনিক, নিয়ন্ত্রন, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দ্বায়িত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উপর ন্যাস্ত করে। সাবেক জেলা স্কুল ইন্সপেক্টরগণ জেলা প্রশাসকদের অধীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৫১ সনে বেঙ্গল (পল্লী এলাকার) প্রাথমিক শিক্ষা আইন সংশোধন করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার জন্য, সরকার পরীক্ষামূলক ব্যাবস্থা গ্রহন করে। নির্বাচিত ইউনিয়নের ৫,০০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নির্বাচন করা হয় ”বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা” পরিচালনা করার জন্য। বাকীগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষা ”বাধ্যতামূলক করা হয়নি”। ১৯৫১ সন পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা ৪ বছর মেয়াদী কোর্স ছিল। ১৯৫২ সনে প্রাথমিক শিক্ষকে ৫ বছর মেয়াদী কোর্স করা হয়।

 

’বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনাকারী’ এবং ’ অ-বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা’ পরিচালনাকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে বিভাজন তৈরী করা হয়। অত:পর সরকার ১৯৫৭ সনে ৫,০০০টি বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনাকারী বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ”মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়” নামকরণ করে। বাকীগুলো ”অ-মডেল” প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে পরিচালিত হয়। মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকগন অ-মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন ও তত্ত্বাবধান করতে পারতেন। প্রথম পন্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগকে গুরুত্ব দেয়া হয়। ১৯৫৯ সনে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। উক্ত শিক্ষা কমিশন, পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে ৮ বছর মেয়াদী কোর্সে উন্নীত করার সুপারিশ করে এবং বয়সের ভিত্তিতে উদার প্রমোশন পদ্ধতি প্রবর্তনেরও সুপারিশ করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পন্চ বার্ষিক পরিকল্পনায়, প্রাথমিক শিক্ষা উপ-খাতের উন্নয়নে বরাদ্ধ বৃদ্ধি করা হয় যাতে বিদ্যালয়ের সুযোগ সুবিধা ও শিক্ষার্থী ভর্তি বৃদ্ধি করা যায়। কিছু কিছু বাবা মা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষাদানকারী কর্তৃপক্ষ ”মডেল” এবং ”অ-মডেল” প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকরণ ও মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকগন কতৃক অ-মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন ও তত্ত্বাবধান মেনে নিতে পারেননি। ১৯৬৫ সনে সরকার সম্মিলিতভাবে ”মডেল” এবং ”অ-মডেল” প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ ”ফ্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়” করে। ঐ প্রকল্পের আওতায় সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে একটি প্রশাসনের অধীনস্ত করা হয় এবং শিক্ষকদের তাঁদের নিজ নিজ যোগ্যতা অনুসারে বেতন ভাতাদি প্রদান করা।

 

বাংলাদেশ আমল
১৯৭১ সনে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ আমল শুরু হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন সংবিধানে প্রাথমিক শিক্ষা রাষ্টের দায়িত্ব হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। বিধানগুলো হলো:
” যে সকল উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র একটি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করবে

(ক) একটি অভিন্ন, জনসম্পৃক্ত ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সব ছেলেমেয়ের জন্য বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার যা আইন দ্বারা নির্ণয় করা যেতে পারে।

(খ) শিক্ষাকে সমাজের চাহিদার সাথে সংযোগ করা এবং সমাজের ঐ সব চাহিদা পূরণে সক্ষম প্রশিক্ষত এবং প্রণোদিত নাগরিক তৈরী করা এবং

(গ) একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করা আইন দ্বারা নির্ধারণ করা যেতে পারে”।

সরকার জাতীয় দায়িত্ব হিসাবে প্রাথমিক শিক্ষাকে স্বীকার করে এবং শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার যা বাংলাদেশে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। স্বাধীনতার সূর্য্য উদয়ের পর থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে পুনর্জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। তারই আলোকে, স্বাধীনতার পর পরই শিক্ষা ব্যবস্থা হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল। প্রতিবেশী দেশগুলোর শিক্ষা পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে বাংলাদেশে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্টা করার জন্য  এর উদ্দেশ্য, কৌশল এবং কর্ম পরিকল্পনা প্রনয়ণের লক্ষ্যে সুপারিশ করার জন্য ১৯৭২ সনে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়।

 

বাংলাদেশের শিক্ষা কমিশন
১৯৭৪ সনে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার জন্য নিন্মলিখিত উদ্দেশ্যাবলী নির্ধারণ করা হয়:

  1. শিশুর নৈতিক, মানসিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব বিকাশের উন্নয়নে শিক্ষাদান।
  2. শিশুকে দেশপ্রেম, দায়িত্বশীল, অনুসন্ধিৎসু ও আইনপরায়ন নাগরিক হিসাবে তৈরী করা এবং তাদের সততা, সঠিক আচরণ, শ্রম, মর্যাদা, ন্যায়বিচারের  প্রতি দয়ালু এমনভাবে  বিকাশ সাধন।
  3. মাতৃভাষায় লিখতে ও পড়তে পারবে এবং গণনা ও হিসাব করতে সক্ষম হবে।
  4. ভবিষ্যত নাগরিকের চাহিদা পূরণে মৌলিক জ্ঞান ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।
  5. পরবর্তী পর্য্যয়ের উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করা।

নতুন একটি জাতির আশা আকাঙ্খার লক্ষ্য পূরণে শিক্ষা অত্যাবশ্যকীয়। এই লক্ষ্যে, শিক্ষা কমিশন পূর্বেই প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারকে নিন্মলিখিত সুপারিশ করেন।

  1. অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা চালু।
  2. অধিক ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে আকৃষ্ট করতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্য্যায়ে অধিক মহিলা শিক্ষক নিয়োগ করা। প্রয়োজনে বালিকা বিদ্যালয় নির্মাণ করা।
  3. ১৯৮০ সনের মধ্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন এবং ১৯৮৩ সনের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীতকরণ।
  4. ঝরেপড়া রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন। আকর্ষনীয় পাঠ্যক্রম চালু, যথোপযুক্ত পাঠ্যপুস্তকের উন্নয়ন এবং বিদ্যালয়ের পরিবেশের উন্নয়ন।
  5. অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু যা বৈজ্ঞানিক, বাস্তবভিত্তিক, সামাজিক অবস্থার সাথে মানানসই এবং পরিবেশের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
  6. প্রাক- প্রাথমিক শিক্ষা চালু।
  7. শিক্ষক প্রশিক্ষণ পদ্ধতির সম্প্রসারণ এবং যথোপযুক্ত পাঠ্যপুস্তকের উন্নয়ন।
  8. প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমী ও জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড স্থাপন।

এখানে উল্লেখ্য যে কমিশনের সকল সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। তবে সরকার ১৯৭৩ সনে প্রাইমারী এডুকেশন টেকিং ওভার অ্যাক্ট নামে একটি আইন দ্বারা  ৩৬,১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন এবং জাতীয়করণকৃত বিদ্যালয়ের ১৫৭,৭২৪ জন শিক্ষককে সরকারি চাকুরীজিবী হিসাবে ঘোষণা দেন। তারপর থেকে রাষ্ট্রের দায়িত্বের অংশ হিসাবে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার উন্নতি ও শক্তিশালীকরণ করা শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়নে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেয়া হয়।